প্রশান্তিময় কোরআনের সুর

সেনাপতি! এত অস্থির লাগছে কেন আমার? কেন বারবার শিহরিত ও তৃষ্ণার্ত হচ্ছি আমি? ঐ কয়েদি আমাকে এ কি শুনাল? রাজা কথাগুলো বলছিলেন আর বারবার সেনাপতির হাত আঁকড়ে ধরছিলেন। সেনাপতি তার হাতটি আরেকটু শক্ত করে ধরে বললেন, মহারাজ! আপনি শান্ত হোন। অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন কী হয়েছে আপনার। কেন আপনি এমন করছেন? রাজা তখন প্রায় কেঁদেই দিলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, বহুবছর আগে শহরের শেষ প্রান্ত ভ্রমণের সময় কেউ একজন এই সুর শুনিয়েছিল। আপনি বিশ্বাস করুন সেনাপতি ঐ সুর শুনে তখন ভেতরটা কেমন করছিল আমার। কিছু সময়ের জন্য কি এক প্রশান্তির স্রোতে ভেসে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমার ব্যস্ততা আমাকে ঐ প্রশান্তির স্রোত থেকে ঝাপটে ধরে নিয়ে এসেছিল। আজ সেই সুর আবার কানে এলো আমার। ফের যখন এই সুর শুনছিলাম আমি বারবার মনে হচ্ছিল কতকাল ধরে যেন এই সুর শ্রবণের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত ছিলাম আমি।
(সেনাপতি রাজার এমন অস্থিরতা দেখে নিজেও স্থির থাকতে পারছিলেন না। রাজা হলেও তিনি সেনাপতির ভালো একজন বন্ধু। রাজ্যের বিষয়াদি ছাড়াও দুজনে একে অন্যের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করেন। কিন্তু শরীর ভালো না থাকায় গত দুদিন তিনি রাজার সঙ্গ দিতে পারেন নি।)
সেনাপতি আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন কয়েদখানায়। সেখানে গিয়ে দেখলেন এক যুবক গভীর মনোযোগে কুরআন তেলাওয়াত করছে। তিনি কিছুক্ষণ সেই সুমধুর তেলাওয়াত শুনে ফিরে এলেন রাজার কাছে। এসে দেখলেন রাজা এখনো বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছেন। কাছে এসে ডাক দিলেন, মহারাজ!
সেনাপতির ডাকে সম্বিত ফিরে ফেলেন রাজা। কিন্তু আবার বলতে লাগলেন এ কোন সুর বাজল আমার কানে!
সেনাপতি দুহাত দিয়ে তাঁকে বসিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি একটু শান্ত হোন মহারাজ। আমি বলছি আপনাকে সব।
রাজা: হ্যাঁ, সেনাপতি! বলুন আপনি। সঙ্গীতাঙ্গনে জন্ম আমার। কত ওস্তাদের কাছে নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধনা করলাম! কত গায়কের সন্নিকটে গেলাম! কত সুর ধরলাম নিজেও। কিন্তু কোনো সুর তো আমায় এমন করে আকৃষ্ট করেনি, এত পাগল করেনি। এ কোন সুর কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই এত মনকাড়া?
সেনাপতি: মহারাজ! এটা রবীন্দ্র বা নজরুলগীতির কোনো অংশ নয়, নয় কোনো লোকগীতিও। এটি মহান রবের পাঠানো সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব আল কোরআন তেলাওয়াতের সুর!
রাজাঃ আল কোরআন তেলাওয়াতের সুর?
সেনাপতি: জ্বী মহারাজ! এই সুর শ্র“তিমধুর করতে কোনো বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। এই সুরের সম্পর্ক হৃদপিন্ডের সাথে, যা শুনলে হৃদয় রবের ভয়ে কেঁদে ওঠে।
রাজা: তাই নাকি?
সেনাপতি : জ্বী মহারাজ! শুধু তাই নয়, এটা এমন এক সঙ্গীত যে সঙ্গীতের একটা হরফ উচ্চারণ করলে বিনিময় হিসেবে আমলনামায় দশটা পূণ্য লিখা হয়। এটা মানুষের জন্য স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত উপহার।
রাজা : তাই যদি হয় তবে আমি কেন সেই সৌভাগ্যবানদের দলে নই?
সেনাপতি : আপনি শান্ত হোন জাহাপনা! এই কোরআন তেলাওয়াত করলে শুধু সওয়াবই হয় না, এখানে স্রষ্টার সমস্ত সৃষ্টি নিয়ে লিপিবদ্ধ আছে। কিসে মানুষের মঙ্গল হয়, কিসে অমঙ্গল হয় সব লিখা আছে। আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই কুরআনের নীতি অবলম্বন করি তাহলে আমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবো না। বরং স্রষ্টার দ্বারা আমাদেরকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।
রাজা : এই কিতাবের আদর্শে যদি আমাদের মঙ্গল হয় তবে কেন আমার রাজ্যে কুরআনের শাসন অকেজো?
সেনাপতি : আপনি চাইলেই এ রাজ্যে কুরআনের আইন চালু হবে মহারাজ।
রাজা : কিন্তু আমার প্রজারা যদি দ্বিমত করে?
সেনাপতি : মহারাজ! এ রাজ্যের প্রজাদের প্রাণের রাজা হচ্ছেন আপনি। প্রজারা খুব ভালোবাসে আপনাকে। তারা আপনার আদেশ পালন না করে কি পারে? আর যে আইন সত্য, সে আইন নিঃসন্দেহে সুন্দর। আপনার প্রজারা তো সুন্দর রাজ্যই চায়।
রাজা : আপনি ঠিক বলেছেন। তবে আমি যে কুরআন তেলাওয়াত করতে জানি না। আমি কি করে এ রাজ্য পরিচালনা করব?
সেনাপতি : আল্লাহ পাক আপনার এই সদ্বিচ্ছাকে কবুল করুন। আপনি চিন্তা করবেন না মহারাজ। আমি তো আছিই আপনার সাথে। কুরআন শিক্ষার আসর থেকে সবচেয়ে দক্ষ ও গুণী শিক্ষককে আমরা আজই ডেকে পাঠাব। তবে তার আগে অনুগ্রহ করে আপনি বলুন যে কোন অপরাধে ঐ যুবককে এখানে বন্দী করা হয়েছে।
রাজা : কাল আমি পাখি শিকার করতে বের হয়েছিলাম। ঐ যুবক বারবার বলছিল যে প্রাণী হত্যা মহাপাপ। আমার রাগ হয়েছিল এই ভেবে যে সামান্য একজন প্রজার কি করে রাজার শখের বিরুদ্ধে কথা বলার স্পর্ধা হয়। তাই আদেশ দিয়েছিলাম ওকে ধরে আনার। কিন্তু ওকে আর ছাড়ব না আমি। সে এখন থেকে এখানেই থাকবে এবং প্রতিদিন তাকে সুললিত কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনাতে হবে। এই সুরে আমার প্রাণ শীতল করার জন্য তাকে মজুরি দেওয়া হবে।
সেনাপতি : আপনার সুন্দর সিদ্ধান্তে আমি মুগ্ধ মহারাজ। মুগ্ধ এই কয়েদিও।
সেনাপতির কথা শুনে রাজা পেছনে তাকিয়ে দেখেন কয়েদিও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েদিকে সেনাপতি জিজ্ঞেস করলেন, সে এই কাজ করতে পারবে কি না।
কয়েদি : জ্বী পারব। তবে কোরআন তেলাওয়াতের বদলে আমি কোনো মাইনে নেব না। বরং মহারাজ যদি অনুগ্রহ করে আমাকে একটা কাজ দিতেন….
তাকে থামিয়ে দিয়ে রাজা বললেন, কাজ তুমি পাবে যুবক। তোমার আর কোনো চাওয়া আছে?
কয়েদি : আপনি আমাদের শাহানশাহ। আপনাকে ওয়াদা করতে হবে-আর কোনো প্রাণী হত্যা না করার।
রাজা খুশিমনে বলে উঠলেন, বেশ! আমি ওয়াদা করছি এ রকম ঘৃণ্য কাজ আর করব না আমি। আমার রাজ্যে কোনো প্রাণী হত্যা হতে দেব না আর। এ কথা শুনে সেনাপতি ও কয়েদি উভয়ে মারহাবা মারহাবা মহারাজ বলে উঠলেন।

Comments

comments

About

Check Also

কারবালার শিক্ষা

শাফীর বয়স বারো পেরুলো। ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা ওকে সব সময় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *