আজমির শরিফে এক প্রহর

শুক্রবার নিয়ে আশুরার ছুটি পেলাম তিনদিন। চার বন্ধু পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম রাজস্থান সফরের। আজমির শরিফ ও জয়পুরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছে মনে পোষণ করছিলাম অনেকদিন ধরে। এবার সে সুযোগটা এলো। রিজার্ভেশন টিকেট কেটে ভোর চারটায় রওয়ানা হলাম। যথাসময়ে ট্রেন এলো। ট্রেনে উঠে জানালার পাশের সিটে বসলাম। হুইসেল দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করলো ফসলি মাঠের মধ্য দিয়ে। তখনো রাতের আঁধার চারপাশে। দিগন্তজোড়া মাঠ। যতদূর চোখ যায় ততদূর। যেনো তার শেষ নেই। সুবহে সাদিকের শুভ্র আভা পূর্ব দিগন্তকে আলোকময় করে তুলেছে। ঝকঝক শব্দ আলোআঁধারির নীরবতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকদূর পর্যন্ত।
একটু পর পুব আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি দিলো। সকল আঁধার দূর হয়ে নেমে এলো প্রভাতের কোমল আলো। সে আলোয় দেখতে লাগলাম মহান রবের অপূর্ব সব সৃষ্টি। শরতের ভোর। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ চারপাশে। ট্রেনের জানালা গলে বইছে এলোমেলো স্নিগ্ধ-কোমল বাতাস। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় পার করছিলাম কেবল।
একটু পর দেখা মিললো সারি সারি পাহাড় ও পর্বতের। যেনো আকাশ ছুঁয়েছে পাহাড়গুলো। মহান আল্লাহর অপূর্ব আর বিস্ময়কর সৃষ্টি এ পাহাড়। বান্দার চোখ জুড়িয়ে যায় পাহাড় দেখে। বিস্ময়ে মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে ‘সুবহানাল্লাহ’ ধ্বনি। সে আশ্চর্যের কথা উল্লেখ করেই পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা কি লক্ষ্য করো না, কীভাবে পাহাড়গুলোকে স্থাপন করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া : ১৯)।
রাজস্থানের তাপমাত্রা দেশের সবচে বেশি থাকে। রোদে পুড়ে যাওয়া পাহাড়গুলো অনেকটা খয়েরি রঙের। গাছপালা তেমন নেই। কেমন যেনো রুক্ষ হয়ে আছে। পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটি ঘরবাড়ি। শত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করে এখানের বাসিন্দারা। শহরের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই এদের। কৃষি কাজ করেই কেটে যায় দিন। এসব দেখতে দেখতে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পর পৌঁছুলাম জয়পুর স্টেশনে। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো, আগে আজমির ঘুরে জয়পুর আসবো। তাই জয়পুরে না নেমে একবারে আজমিরেই চললাম। যখন আজমির স্টেশনে নামলাম তখন বেলা একটা। প্রথমেই পরদিনের ফিরতি টিকেট কেটে নিলাম। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হলাম মাজারে। ট্যাক্সি ড্রাইভার এখানের স্থানীয়। মাজারের ইতিহাস সম্পর্কে টুকটাক জানলাম তার থেকে।
১৯৫০ সালে আজমির শহরটি ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে মর্যাদা লাভ করলেও ১৯৫৬ সালে এটি রাজস্থানের সঙ্গে একীভূত হয়। আজমির শহর রাজস্থানের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (র.)-এর কবরকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে এ মাজার। ভারত তো বটেই, বিদেশ থেকেও মানুষের ঢল নামে এখানে। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (র.) ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ঘোরির সঙ্গে ভারতে আগমন করেন। এসে তিনি আজমিরের ৮০০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ে আস্তানা গড়ে ইসলাম প্রচারে নিমগ্ন হোন। তিনি ধর্মকর্মে বাকি জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছেন এখানেই। পরিগণিত হয়েছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দায়। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। আজমিরেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এরপর সেখানে গড়ে ওঠে প্রসিদ্ধ মাজার আজমির শরিফ। তাঁর মৃত্যু মাসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর রজব মাসে ঘটা করে পালিত হয় ‘ওরস শরিফ(!)’।

ট্যাক্সি থেকে নেমে বিল চুকিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। পর্যটন এলাকা হওয়ায় খাবারের দাম একটু বেশিই। হালকা কিছু খেয়ে রওনা হলাম মাজারে। মাজারের বিশাল ফটক। সেখানে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ ও সবুজ কাপড় পরিহিত মাজারের কয়েকজন লোক। শুনেছি দেওবন্দি জানলে প্রবেশ করতে দেয় না। ঝামেলা করে অনেকসময়। তাই একটু ভয়ে ছিলাম। জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ। ব্যাগ নিয়ে যাওয়াও মানা। ব্যাগ এক জায়গায় দশ রুপিতে গচ্ছিত রেখে জুতা হাতে প্রবেশ করলাম মাজারে। নারী-পুরুষ সমানতালে প্রবেশ করছে। নিজেকে সংযত রেখে এগোতে লাগলাম সামনে। শুরু থেকেই শিয়াদের বিদআতি কর্মকাণ্ড চোখে পড়তে লাগলো। মাজারের ভেতর ও বাইরে সারি সারি ফুলের দোকান। মাজারে উৎসর্গ করতে ফুল কিনে মাজারে ছড়ায় দর্শনার্থীরা। একটু সামনে এগোতে নজরে পড়লো দু’পাশে বিশাল দুটি ডেগ। এর চারপাশে মানুষ ভিড় করে রেখেছে। উৎসুক হয়ে ওপরে ওঠলাম। দেখলাম, একটাতে মাজার ভক্তরা টাকা ফেলছে অন্যটাতে খাদ্যসামগ্রী। টাকায় প্রায় অর্ধেকটা ভরে গেছে ডেগের। সেখান থেকে নামতেই ডানপাশে একটা লম্বা কক্ষ নজরে পড়লো। ওরসের সময় গানবাজনা শোনার জন্য এখানে অবস্থান করে দর্শনার্থীরা। মূল মাজারে প্রবেশ করতে আরেকটা গেটের আশ্রয় নিতে হয়। গেট পেরোতেই সাদা গম্বুজের মাজার। গম্বুজের চারপাশে রয়েছে সোনায় মোড়ানো গম্বুজাকৃতির চারটে সিলিং। মাজারের চারপাশে ভক্তদের প্রচুর ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে এগোলাম। দেখলাম কেউ মাজারে মাথা ঠুকছে, কেউ লাল সুতা বেঁধে মান্নত করছে, কেউ আবার সিজদাও করছে! (নাউজুবিল্লাহ) মাজারের অপর পাশে হাজারো মানুষ ফুল ছড়াচ্ছে। মাজারের একজন লোককে দেখলাম ময়ূরের পাখা দিয়ে তৈরি একধরনের ঝাড়ু দিয়ে ভক্তদের আশির্বাদ দিচ্ছে! এতো মহান একজন মানুষের মাজারে এসব বিদআতি কর্মকাণ্ড দেখে মনটা ব্যথায় ভরে উঠলো। পুরো মাজার শিয়া আর বিদআতিদের দখলে। না বুঝে হাজারো মুসলমান পা দিচ্ছে তাদের ফাঁদে। না বুঝে কেউ হারাচ্ছে মহামূল্যবান ইমান। কে ফিরাবে তাদের? কে বুঝাবে ইমানের মূল্য? সচেতন কোনো মুসলমানের পক্ষে এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়া কখনোই মানায় না। এতে নিজ ইমানেও প্রশ্ন আসতে পারে।
মূল মাজারটি ভেলভেটে মোড়া শ্বেত মর্মরের সমাধি বেদী যা রূপোর রেলিং দিয়ে ঘেরা। পাশেই আছে মইনুদ্দিন চিশতি (র.)-এর কন্যা ও শাহজাহান কন্যা চিমনি বেগমের সমাধি। কিছু ওজিফা পাঠ ও যিয়ারত করে বেরিয়ে এলাম মাজার থেকে। মাজারের পাশেই মসজিদ। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে দাস সুলতান ইলতুতমিশ এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আর শেষ ১৬ শতকে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের হাতে। এর প্রবেশদ্বারটি তৈরি করেছিলেন হায়দারাবাদের নিজাম। ১৫৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছর আগ্রা থেকে পায়ে হেঁটে সম্রাট এই দরগায় আসতেন। মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ে বেরোলাম। মাজারের দক্ষিণ দিকে বিশাল একটি পাহাড়। শুনেছি তার ওপর তারাঘর নামে একটা জায়গা আছে। খুব সুন্দর নাকি জায়গাটি। পাহাড়টিতে চড়ার ইচ্ছে হলো চারজনেরই। বাহিরে গিয়ে সেখানে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করলাম একজনকে। সে জানালো, তারাঘর ছয় কিলোমিটার ওপরে। পায়ে হেঁটে ওঠার সাহস তেমন কেউ করে না। গাড়িতে ভাড়া ৫০ রুপি করে। আমরা হেঁটেই ওপরে চড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যতই ওপরে উঠছি ততই পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য নজর কাড়ছে। পাহাড়ের গায়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। শক্ত পাথরগুলো হাজার বছর ধরে এভাবেই পাহাড়কে জড়িয়ে রেখেছে। পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে আছে গাছগাছালি ও বিভিন্ন প্রজাতির গুল্ম। যেনো সবুজের নিকুঞ্জ একটা। ওপরে ওঠার জন্য পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। এগুলো মোঘল আমলের তৈরি। সে যুগের প্রতিটি শিল্পশৈলী বিস্ময়কর এবং মুগ্ধকর। কিছুক্ষণ ওঠার পর হাঁপিয়ে উঠি। ঠাণ্ডা পানীয় পান করে ফের চড়তে শুরু করি। পথের মাঝখানে জায়গায় জায়গায় দোকানিরা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বসেছে। এক জায়গায় পড়লো আরেকটি মাজার। একেবারে চূড়ায় উঠতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগলো। চূড়ার চারপাশ বিশাল আকৃতির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মোঘল আমলে যুদ্ধের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছিলো এগুলো। এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখান থেকে নিচে তাকালাম। দুনিয়ার বিস্ময় যেনো একসঙ্গে চোখে জড়ো হলো। পুরো আজমির শহর দেখতে পেলাম এখান থেকে। দূরের পাহাড়গুলো খুব কাছের মনে হলো। সবুজে আবৃত পাহাড়গুলোর অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো ‘সুবহানাল্লাহ’। নিচের বাড়িঘর আর মানুষগুলো অনেক ছোট ছোট মনে হলো। ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম পাহাড়ের অপূর্ব সে দৃশ্যপট। জায়গার নাম তারাঘর হলেও সেখানে কোনো তারাঘর নেই। ওপর থেকে নিচের কান্তরূপটাই দেখতে আসে হাজারো পর্যটক। সন্ধ্যে নামতে বেশি সময় নেই। আশপাশটা ঘুরে দেখে ফের পায়ে হেঁটে রওনা হলাম নিচে। আসার পথে সূর্য ডোবার অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যে হারিয়ে ছিলাম কতক্ষণ। নিচে নামতে বেশি সময় লাগলো না। নামাজ পড়ে হালকা নাস্তা করলাম। স্টেশনে গিয়ে জয়পুরের ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

Comments

comments

About

Check Also

আশা পূরণের মালিক আল্লাহ

দুই হাজার আট সাল। ‘সাফা’ তখন জামাতে রাবের ছাত্রী। সাফাদের জামাতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মোট ১২জন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *