আজাদী ডাইরি

আরাফাত লুকিয়ে আছে একটি পাহাড়ি গুহায়। এটি ঠিক গুহা নয়। পাহাড় জঙ্গলের ভেতর গুহার মতো করে বানানো হয়েছে কয়েকটি কুঠরী। এ স্থানের সন্ধান হাতেগোনা লোক ছাড়া কেউ জানে না। এ এলাকার চারদিকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী দ্বারা ঘেরা।
কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে গোটা বিশ্ব থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সামরিক সদস্য এখন সেখানে। কারাগারগুলোতে জায়গা সঙ্কুলান হচ্ছে না। অসংখ্য মানুষকে পাঠানো হচ্ছে বাইরের কারাগারে। স্বীয় জন্মভূমির সমস্ত খবর রাখা যায় এখান থেকে। আরাফাতে দায়িত্বই এখন এটা। দিনের বেলা সে বাইরে ছদ্মবেশে ঘুরতে যায় সন্ধ্যার সাথে সাথে আবার ফিরে আসে।
কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দানকারী দেশটির সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষার নামে এখন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
আরাফাত একটি বড় ডাইরিতে লিখে রাখছে চলমান সমস্ত ঘটনা। তাঁর আশা, দেশটি একদিন স্বাধীন হবে। এই কলঙ্কজনক ইতিহাস সবাই জানবে।
প্রথম পৃষ্ঠায় আরাফাত লিখেছে- ৫ আগস্ট কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার কাশ্মীরকে ভেঙ্গে রাজ্যের মর্যাদা থেকে নামিয়ে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে।
আমাদের মাতৃভূমিতে আমরা আজ অবরুদ্ধ। বিভিন্ন মিডিয়া বলছে, প্রতি ৮ জনের জন্য একজন সেনা মোতায়েন রয়েছে। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের আগে ও পরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, অ্যক্টিভিস্টসহ প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষকে আটকও করা হয়েছে। কাশ্মীরের কারাগারগুলো ভরে গেছে মানুষে। জালিমরা বলছে, এসব পদক্ষেপ শুধুই রাজ্যটির জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা বেঁচে থাকা এখন সঙ্কটাপন্ন। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে জুলুম এমনটা করে যাচ্ছে। জালিমরা যাদেরকে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছে এরা প্রকৃতপক্ষে কাশ্মীর স্বাধীন করার লড়াইয়ে ব্যস্ত। আমিও তাদের একজন।
এবার যা বর্ণনা করবো তা অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। অস্বস্তির কারণ মনে হতে পারে কারো কাছে। কিন্তু আমি যা লিখছি তা নিজ চোখে দেখেই লিখছি।
দক্ষিণ কাশ্মীরের অন্তত ৬টি গ্রাম রয়েছে যেগুলোর মানুষ সবসময় স্বাধীনতাকামী। কয়েক বছর ধরে ভারত বিরোধী উত্থানের অন্যতম কেন্দ্র এই গ্রামগুলো। গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করছে জালিম সৈনিকরা। এখানকার ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ভয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববাসী আমার দেশের করুন কাহিনীর কিছুই জানতে পারছে না।
গ্রামবাসীদের শরীরের ক্ষত দেখলে যেকেউ চমকে উঠতেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা সবধরনের নির্যাতন করছে দলবেঁধে। একজন ভুক্তভোগীর পায়ে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখে আমি আৎকে উঠেছিলাম। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশির নামে যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। মানুষকে যাকে যেভাবে পেয়েছে তাকে আটক করে নিয়ে গেছে। এখনো তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। এক গ্রামের দুই ভাইকে বাড়ি থেকে জোর করে বের করে নিয়ে গিয়ে আরও কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে দাঁড় করায়।
তার পর ব্যাপক মারধর করে। তারা জানতে চাইলেন, আমরা কী করেছি? কিন্তু সৈনিকরা তাদের কোনো কথাই শোনেনি, কিছু বলেওনি, তারা শুধু মারতেই থাকে।
আরাফাতের ডাইরির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় মানচিত্রের মতো কিছু একটা আঁকা। যায় তাতে একটি শব্দও লেখা নেই। তৃতীয় পৃষ্ঠায় আবার বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের চিত্র। সে লিখেছে- সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে আমার হাত কাঁপছে। তবু কিছুটা লিখে রাখছি। যদি কোনো দিন এই ডাইরি কারো কাছে পৌঁছে অন্তত কিছুটা অনুমান করতে পারবে সবাই।


দুই ভাইয়ের একজনের শরীরের প্রতিটি অংশে তারা আঘাত করে। তারা লাথি দেয়, লাঠি ও তার দিয়ে মারে, বৈদ্যুতিক শকও দেয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন সে অজ্ঞান হয়ে যায় তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আবার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। নির্মম সেই নির্যাতনের কথা অপর একব্যক্তি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে যে, লাঠি দিয়ে মারার সময় আমরা যখন চিৎকার করছিলাম, তখন আমাদের মুখ বন্ধ করার জন্য মুখে কাদা ভরে দেয়। আমরা তাদের বারবার বলতে থাকি যে আমরা নির্দোষ। কেন আমাদের নির্যাতন করছো? কিন্তু তারা এসব কোনো কথাই শোনেনি। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের একপর্যায়ে আমরা অসহ্য হয়ে তাদের বলতে থাকি যে, দয়া করে আমাদের এভাবে আর মেরো না। এর চেয়ে গুলি করে একেবারে মেরে ফেলো। কিন্ত তাতেও যখন তারা ক্ষান্ত হয়নি তখন আমরা আল্লাহর কাছে অনুনয় করে প্রার্থনা করতে থাকি যেন আমাদের তিনি উঠিয়ে নেন।
একজন গ্রামবাসীর পিঠে নির্যাতনের ফলে হওয়া ক্ষতচিহ্ন দেখে আমার খুব কান্না পায়। তাকে ক্ষতচিহ্ন ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে সে বলে- গ্রামের কিশোর ও তরুণদের মধ্যে কে কে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে তাদের নাম বলতে সেনা সদস্যরা আমাকে বারবার চাপ দিতে থাকে। এই গ্রামের তরুণ ও কিশোররা বিগত কয়েকবছর ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের প্রতিমূর্তি হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তারা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা চায়।
সৈনিকদের বললাম, তাদের নাম জানি না। তবে তাদের দেখলে চিনতে পারবো। কিন্ত তারা আমার কথা বিশ্বাস করলো না। বললো- চশমা, জুতা ও কাপড় খুলতে। সবকিছু খুলে ফেলতে বাধ্য হলে শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। হাত পা বেঁধে উপুড় করে শুইয়ে পিঠে চাকু ঢুকিয়ে দেয়। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিলাম। তারা পা দিয়ে মাটির সাথে আমার মুখ চেপে ধরে। এর পর তারা লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিঠের উপর নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। এভাবে প্রায় দুঘন্টা যাবত বিভিন্ন ধরনের কষ্ট দিতে থাকে। যখনই অজ্ঞান হয়ে যেতাম, বৈদ্যুতিক শক দিতো জ্ঞান ফেরানোর জন্য।’
আরাফাতের ডাইরিতে অন্তত বিয়াল্লিশ পৃষ্ঠা লেখা রয়েছে। সমস্ত লেখা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের চুম্বক অংশ শুধু তুলে ধরা হলো। সে অষ্টম পৃষ্ঠায় লিখেছে-এক তরুণ বললো, সৈনিকরা যদি আবার আমার সাথে এরকম আচরণ করে তাহলে আমি যে কোনোভাবে এর প্রতিরোধ করবো। প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নেবো। এতো দিন স্বাধীনতাকামীদের পক্ষও নেইনি আর বিরোধিতাও করিনি। কিন্তু আমরা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মনে মনে সবাই মাতৃভূমির স্বাধীনতা চাই। প্রয়োজন হলে দেশের জন্য প্রাণ দেবো। তবু এই অন্যায় নির্যাতন সহ্য করবো না। সৈন্যরা আমাকে সতর্ক করে বলেছে যে, গ্রামের কেউ যদি কোনো ধরনের বিক্ষোভে অংশ নেয় তাহলে তাদের পরিণতিও একই হবে। ডাইরির দ্বাদশ পাতায় আরাফাত লিখেছে-
বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা ‘অভিযোগ অনুযায়ী কোনো নাগরিকের সঙ্গে জবরদস্তি করেনি’। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আমান আনন্দ দাবি করেন ‘এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। এই অভিযোগগুলো শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা থেকে উদ্ধৃত।’ কতবড় মিথ্যুক সেনাবাহিনীর এই মুখপাত্রগুলো। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। দোকান, ফার্মেসী বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘ কার্ফিউ জারির কারনে মানুষ না খেয়ে মরতে বসেছে। ওষুধের অভাবে শিশুরা মরে যাচ্ছে, তবু নিকটস্থ হাসপাতাল বা ফার্মেসীতে যেতে দিচ্ছে না। এই সব জালিমদের পরাজয় নিশ্চিত। পরের পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে-কাশ্মীরের এমন একটি অঞ্চলের কথা লেখছি যেখানে একটি সেনা ক্যাম্প রয়েছে। সেনা সদস্যরা নিয়মিত বিচ্ছিন্নতাবাদদের বা স্বাধীনতাকামীদের খোঁজে ওই গ্রামগুলোতে তল্লাশি অভিযান চালায়। গ্রামবাসীদের সাথে স্বাধীনতাকামীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও দেখা যায়, প্রায়ই সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদের কাউকে না কাউকে তুলে নিচ্ছ। কারো উপর নির্যাতন বা কাউকে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে সেনারা বলে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খবর জোগাড় করে না দিলে তাকে এভাবে নির্যাতন করা হবে, তার নামে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। প্রয়োজনে তাকে হত্যাও করা হবে। বিভিন্ন এলাকায় এধরণের হুমকি দিচ্ছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এই কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে এমন নির্যাতন করা হচ্ছে যে, দুসপ্তাহ পরেও সে সোজা হয়ে বিছানায় শুতে পারছে না।
ডাইরির একুশ নং পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে- ‘এ রকম নির্যাতিত অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে যুবক কিশোরগণ। কেননা, সেনারা তাদেরকে এমনভাবে মারে যেন মানুষ না, পশু পেটাচ্ছ। নির্যাতনের শিকার এক কিশোর দুদিন আগে আমাকে বলেছে- অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন সেনা সদস্য তাকে মাটিতে ফেলে রড, লাঠি, তার দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। এই নির্যাতনের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সকালে এক ব্যক্তি তার সাথে ঘটিত নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমার জ্ঞান প্রায় ছিলই না। তারা আমার দাড়ি ধরে এত জোরে টানে যে আমার মনে হচ্ছিল যে আমার দাঁত উপড়ে আসবে।’ পরে জ্ঞান ফিরলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজনের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে, একজন সৈন্য তার দাড়ি পুড়িয়ে দিতে চাইলেও আরেকজন সৈন্য বাধা দেয়ায় শেষপর্যন্ত তার দাড়ি পুড়ানো হয় নি।
কাশ্মীরের লোকজন জন্তুর মতো খাঁচাবন্দি হয়ে আছে। আমাদের মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছি আমরা। বাইরের দুনিয়া এমনকি, কাশ্মীরে বসবাসরতদের মধ্যেও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে মোবাইল এবং ইন্টারনেট সেবাও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য……’ উপরের অংশটি আরাফাতের ডাইরির সর্বশেষ পৃষ্ঠা। সে যেন আরও কিছু লিখতে চেয়েছিল। হঠাৎ খুব বেশি ঘুম চলে আসায় ডাইরিটি এভাবে রেখে দেয়। সেটি শক্ত টিনের বাক্সে ঢুকিয়ে গুহার একটি কুঠরীতে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখে- একদল দানবাকৃতির সৈন্য তাকে বন্দি করে রেখেছে। সে সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করছে কিন্ত কেউ কিছুই শুনছে না। সে দেখলো দানবাকৃতির সৈন্যগুলো ডাস্টবিনের দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খাচ্ছে, আগুনের তৈরি পোশাক পরে আছে আর একধরনের কষ্টে সবাই সমস্বরে বুকফাটা আর্তনাদ করছে। তাদের এই আর্তনাদ চার দেয়াল পেরিয়ে বাইরেও যাচ্ছে না।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *