অভিনয় নয় ভালোবাসা

শ্যামল প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মতো মানুষের জীবনেও ঘটে নানান পরিবর্তন। একেক ঋতুতে প্রকৃতিতে একেক রকম সাজ …কখনও খরা …কখনও মেঘলা আকাশ …কখনও বা রিমঝিম বৃষ্টি …কখনও বন্যা …ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির সাজ সজ্জার মতোই জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন তখনই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে …আনমনে জুঁই ভাবছে তার ফেলে আসা অতীতের দিনগুলি নিয়ে। দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সুখী পরিবার জুঁইয়ের। স্বামী ব্যবসায়ী। অর্থ সম্পদ যা কিছু আছে একেবারে অপ্রতুল নয়…স্বচ্ছলতা আছে বটে তবে কোথায় যেন পরাধীনতার শিকল তার সুখগুলোকে মনের মতো উপভোগ করতে দেয় না।
সোহেল তার স্ত্রীকে যে ভালোবাসে না মোটেই তেমনটা কিন্তু নয়; তবে তার কথাবার্তায় তীক্ষèভাবে খোঁটা দেওয়া স্বভাবের কারণে জুঁই ভীষণ কষ্ট পায়। বন্ধুত্বসুলভ ভাবে কথা বলার চেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণতা প্রদর্শন করাটা জুঁই একেবারেই পছন্দ করে না। কারণ ছোটবেলা থেকেই তার বাবাকে দেখে এসেছে মাকে ভীষণভাবে ভালোবাসতে আর বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্কের মাধ্যমে সংসারজীবন অতিবাহিত করতে। তার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথেই জুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে প্রায় এক যুগ ধরে। বিয়ের সময় জুঁই তার হবু স্বামীকে কেবল একটা শর্ত দেয় …তাহলে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া যতটুকু করতে তার ইচ্ছে হবে। তখন আগ্রহ চিত্তে জুঁইকে সোহেল বলেছিল:
‘তুমি পড়াশোনা করবে …আমি করাব। তবে এই কথাটা আমার বাবামাকে বলবে না…’
যাহোক তার কিছু দিন পরেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। জুঁই চলে আসে কয়েক গ্রাম দূরে তার শ্বশুরালয়ে। তার শ্বশুর শাশুড়ি বাসাবাড়ি থাকাটাকে অপছন্দ করতেন। আর সোহেলও চাইত জুঁই তাদের বাড়িতেই থাকুক। তাই বিকম পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়াটা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শ্বশুরবাড়ির নানান কর্তব্য কর্ম করে লেখাপড়া করাটা তার কাছে দুরূহ মনে হত। পরীক্ষার কিছু দিন আগে তাই সে প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দেওয়ার মনঃস্থির করে। শ্বশুরবাড়িতে থেকে পড়াশোনার সুযোগ তেমন ছিল না বলে বাবাবাড়িতে দিন দশেক থাকতে পারলে সে সময়টাতে নোট তৈরি করা সহ লেখাপড়ার যাবতীয় কাজগুলো যতটা সম্ভব সেরে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা করত জুঁই। এভাবে করে নিজের সাথে যুদ্ধ করে বিএ পরীক্ষায় যখন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হল সেটা যেন তার কাছে স্ট্যান্ড করার মতোই আনন্দের মনে হয়েছিল। তবে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব অবাক হয়েছিল তার রেজাল্টে। তারা কেউ ভাবতে পারেনি এতটা ভালো ফলাফল করবে জুঁই। তার শ্বশুর একদিন নৌকা করে জুঁইকে নিয়ে বাবাবাড়ি পৌঁছে দিতে যাবার পথে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“আচ্ছা বৌমা, আমাকে একটা কথার উত্তর দাও তো …আমি মাঝেমধ্যে ভাবলে বেশ অবাক হই কিভাবে তুমি বিএ পরীক্ষায় ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছ…তোমাকে তো কখনওই পড়তে দেখিনি?”
কথার ধরণে জুঁই বুঝতে পেরেছিল তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন। জুঁই হেসে ফেলে উত্তর দেয়:
“আব্বা! আমি যাই করি নকল করিনি…”

“কিন্তু কি করে তোমার এতটা ভালো রেজাল্ট হয়েছে?” তার শ্বশুর জানতে চাইলেন।
জুঁই বলল, ‘আব্বা! আমি যে কয়দিন সময় পেয়েছি বাবাবাড়ি থাকার, তখন কেবল পয়েন্টগুলো টুকে রাখার চেষ্টা করেছি… পরীক্ষা হলে নিজের মতো করেই সেগুলো নিয়ে বিশদভাবে লিখেছি।’
যাইহোক এভাবে করে কোন রকমে বিএ পাশ করা হলেও এম এ ভর্তির অনুমতি মিলছে না জুঁইয়ের। শ্বশুরবাড়ির সবাই অরাজি আর সবচেয়ে বেশি অরাজি ছিল তার স্বামী সোহেল। মানুষ কি করে তার প্রতিশ্র“তির খেলাফ করতে পারে সেটা ভাবলে তার ভীষণ কষ্ট হত। কারণ জীবনে সে যাকে যখন কোন প্রতিশ্র“তি দিত তা রক্ষার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করত। তবে এক্ষেত্রে করার কিছুই নেই তার। সমাজে বেঁধে দেওয়া সীমান্ত অতিক্রম করার সাধ্য নেই জুঁইয়ের। তার খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করবে সমাজের উন্নয়নের জন্য … সহযোগিতা করবে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারগুলোকে…পাশে এসে দাঁড়াবে বঞ্চিত নারীদের। নিজের স্বার্থেই জীবন পার করে দেওয়া মানুষগুলোর কাতারে থাকাকে জুঁই কোন কালে কখনওই পছন্দ করত না। তার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বললে তার স্বামী তাকে উত্তর দেয়,
“বাচ্চাদের লেখাপড়ার কথা না ভেবে তুমি নিজের লেখাপড়া নিয়ে, নিজের জীবনের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যাকুল থাক কেন?’
কথাটা শুনলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে জুঁইয়ের। তবে হাল ছাড়ার পাত্রী নয় জুঁই। স্কুল জীবনে অধ্যবসায়ের শিক্ষা তার মনে বারবার সাহস যুগিয়েছে… সাহস যুগিয়েছে স্রষ্টার রহমতের প্রতি তার অগাধ আস্থা… সে সিদ্ধান্ত নেয় তার ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই সে পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করবে…সম্ভব হলে স্কুল বা কলেজে শিক্ষকতা করার ইচ্ছে আছে তার …
আজও তার অপেক্ষায় থাকা বাবুলকে বিয়ে করে সংসারী হবার জন্য অনুরোধ ও জুঁইয়ের দিকে ছুড়ে দেওয়া সেদিনের একটা কথা তাকে বিদ্ধ করে বারবার। বাবুল জুঁইকে বলেছিল,
‘তোমরা সবাই অভিনয় করছ।’
কথাটা যে শুধু জুঁইয়ের দিকেই যায়নি সেটা বুঝলেও নীরব থাকা ছাড়া তার আর কি ই বা উত্তর দেওয়ার ছিল। বাবুল আর জুঁই একই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। তাকে বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা কখনওই তার মনে আসেনি। বাবুল জুঁইকে যে ভালোবাসত সেটা জুঁই বুঝতে পারত। তবে ভালোবাসা কখনওই মনের বিপরীতে হয় না…। তাদের সাথে তেমন কোন কথা হত না প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বিষয় ভিন্ন। অভিনয় নাকি ভালোবাসা তার চরিত্রকে রূপায়িত করছে? বিবেকের কাছে প্রায়ই প্রশ্ন করে জুঁই। তার বিবেক তাকে প্রতিবারই উত্তর দেয়:
ভালোবাসার রূপরেখা অনেক …মানুষ কেবলই নিজের জন্য ভালোবাসে না….স্রষ্টাকে খুশি করতেও মুমীন মুসলিম ভালোবেসে থাকে …যদিও অনেক কিছু মনমতো মতমতো নাও হয়ে থাকে …তবু স্রষ্টার ভালবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াটা কি অভিনয়? অবশ্যই নয়…

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *