মুক্তির সহজতম উপায় মুখের সংশোধন

নির্বাচিত আয়াত
হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর (তাকওয়া অবলম্বন কর) এবং সঠিক কথা (কওলে সাদীদ) বল; তাহলে তিনি তোমাদের আমল সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে। আল-কুরআন, সূরা আহ্যাব ৩৩:৭০-৭১
আয়াতের বিষয়বস্তু দু’টি
আয়াতে কারীমায় দু’টো বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
১. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন এবং
২. কওলে সাদীদ বা সঠিক ভাষণ। সাথে-সাথে এমন আমলের দু’টি শুভ পরিণতির কথা বলে দেয়া হয়েছে।
তাকওয়া কাকে বলে?
সফওয়াতুত্ তাফাসীর গ্রন্থ প্রণেতা সূরা বাকারার ২ নং আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন : ১) মুত্তাকী বলা হয় তাদেরকে, যারা আল্লাহর আদেশগুলো মান্য করে, নিষেধগুলো বর্জন করে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁরই আযাব থেকে আত্মরক্ষা করে। ২) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন : মুত্তাকী হচ্ছেন তারা, যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে আল্লাহর আনুগত্য করে যায়। ৩) হাসান বসরী (রহ.) বলেন : মুত্তাকীরা আল্লাহ কর্তৃক তাদের ওপর হারামকৃত জিনিস থেকে বেঁচে থাকে এবং তাঁদের ওপর অর্পিত ফরয-ওয়াজিব আদায় করে। মুহাম্মাদ আলী আস্-সাবূনী, সফওয়াতুত্ তাফাসীর, (দারুল ফিক্র, বৈরুত, লেবানন) পৃ. ১/২৬
কওলে সাদীদ (ছাদীদ) কি?
১. কওলে সাদীদ অর্থ, ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত কথা। Ñতাফসীরে কাশশাফ (দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর), পৃ. ৩/৫১৯
২. আল্লামা ইবনে কাছীরের (রহ.) মতে, ১) কওলে সাদীদ হচ্ছে, এমন সৃদৃঢ় কথা, যাতে বক্রতা কিংবা বিকৃতি কোনটিই নেই। ২) হযরত ইকরামা বলেছেন : কওলে সাদীদ হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ৩) কেউ কেউ বলেছেন : কওলে সাদীদ হচ্ছে সত্য কথা। ৪) তাফসীরবিদ মুজাহিদের মতে : সঠিক কথাই কওলে সাদীদ। প্রতিটি বক্তব্যই সঠিক। Ñতাফসীরে ইবনে কাছীর (আল-দার আল-আলামিয়্যাহ, কায়রো, মিশর), পৃ. ৩/৭৩৬
কওলে সাদীদ অবলম্বনের দু’টি উপকারিতা
কওলে সাদীদ অবলম্বন করলে আল্লাহ তাআলা তাকে প্রতিদান দিবেন এভাবে যে, ১) তার আমল সংশোধন করে দেবেন, অর্থাৎ, তাকে নেক আমলসমূহের তাওফীক দিবেন আর ২) ক) অতীতে কৃত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং খ) ভবিষ্যতে যে গুনাহ সংঘটিত হবে, তা থেকেও তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা লাভের সুযোগ করে দিবেন। Ñতাফসীরে ইবনে কাছীর, পৃ. ৩/৭৩৬
তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের সহজ উপায় কওলে সাদীদ অবলম্বন বা সত্য-ভাষণ
এ আয়াতে মুসলমানদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টি নির্দেশের প্রথমটি হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন। তাকওয়া বলা হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিধানসমূহের পরিপূর্ণ আনুগত্য তথা তাঁর যাবতীয় আদেশ পালন এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরূহ কাজ থেকে বিরত থাকাকে। এটা সহজ কোন কাজ নয়। তাই তাকওয়ার নির্দেশের পর সাথে-সাথেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে কওলে সাদীদ অবলম্বন বা কথাবার্তা সংশোধনের। এটাও তাকওয়ারই এক অংশ; কিন্তু এমন অংশ, যা আয়ত্তে এসে গেলে তাকওয়ার অবশিষ্ট অংশগুলো আপনা-আপনি অর্জিত হতে থাকে। যেমন, এ আয়াতেই কওলে সাদীদ অবলম্বন সাপেক্ষে বলা হয়েছে, ‘এটি করলে তোমাদের আমলসমূহ আল্লাহ সংশোধন করে দেবেন।’ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, পৃ. ১০৯৯
আল-কুরআনের বৈজ্ঞানিক কর্মপন্থা
“কোরআন পাকের সাধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে চিন্তা করলে জানা যায় যে, যেখানেই কোন কঠিন ও দুরূহ আদেশ দেয়া হয়, সেখানেই তা সহজ করার নিয়মও বলে দেয়া হয়। খোদাভীতি (তাকওয়া) সমস্ত ধর্মকর্মের নির্যাস এবং এতে পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করার ব্যাপার। তাই সাধারণভাবে যেখানে আল্লাহকে ভয় করার আদেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে এর পরেই এমন কর্ম বলে দেয়া হয়েছে, যা অবলম্বন করলে খোদাভীতির অন্যান্য স্তম্ভ পালন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে সহজ করে দেয়া হয়। আলোচ্য আয়াতে ‘তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর’ আদেশের পর ‘আর তোমরা সঠিক কথা বল’ শিক্ষা দেয়া এরই একটি নযীর।” … অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথী হও’ -এতে খোদাভীতিকে সহজ করার জন্যে এমন লোকদের সংসর্গ অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, যারা কথায় ও কাজে সাচ্চা। এর মানে যারা আল্লাহর ওলী।” Ñতাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, পৃ.
আলোচ্য আয়াতের গুরুত্ব এবং তাকওয়া ও কওলে সাদীদ-এর ফযীলত
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখনই (বক্তব্যের জন্য) মিম্বারে দাঁড়াতেন আমি তাঁকে এই আয়াতখানা বলতে শুনতাম- “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।” ইবনে আবিদ্দুনইয়া, কিতাবুত্ তাকওয়া; সূত্র : তাফসীর ইবনে কাছীর (আল-দার আল-আলামিয়্যাহ, কায়রো, মিশর), পৃ. ৩/৭৩৬
আরো যে-যে উপায়ে তাকওয়া (আত্মশুদ্ধি) অর্জন করা যায়
কুরআন মাজীদে মোটা দাগে তাকওয়া অর্জনের কয়েকটি উপায় পাওয়া যায়। এখানে সেগুলোর উল্লেখ প্রাসঙ্গিক এবং উপকারী হবে ইনশাআল্লাহ।-
১) আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কষ্ট পায়, সতর্কতার সাথে এমন কাজ পরিহার করা। (সূরা আহ্যাব ৩৩:৬৯)। ২) সত্য ও সঠিক কথা বলা। (সূরা আহ্যাব ৩৩:৭০)। ৩) কথায় ও কাজে সাচ্চা, এমন লোকের সংসর্গ অবলম্বন। (সূরা তাওবা ৯:১১৯)। ৪) পরকাল-চিন্তা (মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী কবর, কিয়ামাত, হাশর, মীযান, পুলসিরাত, আমলনামা, হাওযে কাওছার, শাফাআত, জান্নাত, জাহান্নাম, পরকালের পাথেয় এবং নিজের চূড়ান্ত পরিণতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করা।) (সূরা হাশর ৫৯:১৮)।
এক নজরে আয়াতের সারমর্ম ও শিক্ষা
১. আলোচ্য ১ম আয়াতে আল্লাহ মুমিনদেরকে দু’টি নির্দেশ দিয়েছেন- ১) তাকওয়া অবলম্বন ও ২) সত্য ও সঠিক ভাষণ।
২. তাকওয়া অবলম্বনের ক্ষেত্রে মাকরূহ বিষয়াবলিও এড়িয়ে যাওয়ার নয়।
৩. কওলে সাদীদ অবলম্বন করলে মৃত্যুর আগে হলেও গোনাহমুক্তি ও তাওবা নসীব হওয়ার আশা করা যায়।
৪. আত্মশুদ্ধি ও গোনাহ-মুক্তির সহজ সমাধান কওলে সাদীদ অবলম্বন বা মুখের সংশোধন।
৫. নবীজী এই আয়াত মিম্বারের প্রতি খুতবায় বা অধিকাংশ খুতবায় পড়তেন; উম্মতেরও তাই উচিত।
৬. আল-কুরআন মানবচরিত্রের সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ কিতাব; এটির বর্ণনাপদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত এবং প্রভাব বিস্তারকারী।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *