নির্বাচিত ‘ফিকহুস্ সুনান’১ মূল আরবি গ্রন্থকার: মুফতি আমীমুল ইহসান মুজাদ্দিদী বারকাতী রহ.২

কিয়ামে রমাজান বা তারাবিহ’র সালাত (মূল কিতাব, পৃ. ১০৫-১০৬)
১. হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ স. ইরশাদ করেছেন ঃ যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজান মাসে নামাজের মাধ্যমে রাত জাগরণ করবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। (১) বুখারি, ১/১০
২. হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, এক রাতে রাসুলুল্লাহ স. মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করলেন, তাঁর সাথে সাধারণ মানুষও সালাত আদায় করল; দ্বিতীয় রাতেও তিনি সালাত আদায় করলেন, সে রাতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেল; এরপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতেও লোকজন সমবেত হল কিন্তু রাসুলুল্লাহ স. গৃহ থেকে বের হয়ে তাদের কাছে গেলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি স. তাদের উদ্দেশ্যে বললেন : তোমাদের গত রাতের তৎপরতা আমি লক্ষ্য করেছি; তোমাদের কাছে আসতে আমাকে এ বিষয়টিই বাধা দিচ্ছিল যে, আমি ভয় পাচ্ছিলামÑ বিষয়টি (আলোচ্য সালাত) তোমাদের ওপর ফরজ করে দেয়া হবে। আর ঘটনাটি ছিল রমজান মাসের। (১) বুখারি, ১/১৫২
৩. হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ স. রমজান মাসে কিয়ামুল লাইল করতে (রাতের সালাত আদায় করতে) জোর তাগাদা দেয়ার পরিবর্তে উৎসাহ দিতেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ স. ইনতেকাল করেন আর কিয়ামুল লাইল-এর বিষয়টি এভাবেই থেকে যায়। হজরত আবু বকর রা.-এর খেলাফাত-কালে এবং হজরত ওমর রা.-এর খেলাফাতের শুরুর দিকেও বিষয়টি একইভাবে চলতে থাকে। (১) মুসলিম, ১/১৫৮
৪. আবদুর রহমান ইবনে আবদ আল-কারি বলেন, আমি রমজানের এক রাতে হজরত ওমর রা.-এর সাথে মসজিদে নববিতে গেলাম, দেখলাম লোকজন ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আছেনÑ কেউ একাকী সালাত আদায় করছেন, কেউ বা সালাত আদায় করছেন আর তার পেছনে (ইকতিদা করে) ছোট এক জনসমষ্টি সালাত আদায় করছে। ওমর রা. বলেন, আমি মনে করি, এদেরকে যদি একজন কারি সাহেব৩-এর পেছনে একত্রিত করে দেই তাহলে তা তুলনামূলক উত্তম হয়; পরে তিনি এ বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন এবং কুরআন-বিশেষজ্ঞ সাহাবি হজরত উবাই বিন কা’ব রা.-এর নেতৃত্বে এদেরকে সমবেত (জামাআতবদ্ধ) করে দেন। পরবর্তীতে কোন এক রাতে আমি আবার হজরত ওমর রা.-এর সাথে বের হই, তখন লোকজন তাদের কারি সাহেব-এর পেছনে সালাত আদায় করছিল। দৃশ্যটি দেখে হজরত ওমর রা. মন্তব্য করলেন, কতই না উত্তম বিদআত৪ এটা! তবে এরা যে সময়টা ঘুমিয়ে কাটাবে (শেষরাত) সেটা তুলনামূলকভাবে বেশি ভাল ঐ সময়ের চেয়ে যখন এরা (সালাতের মাধ্যমে) কিয়ামুল লাইল (রাতজাগরণ) করছে।৫ এ কথা বলে তিনি শেষরাতকে বোঝাতে চেয়েছেন; আর লোকজন তো তখন রাতের প্রথমাংশেই কিয়ামুল লাইল করত। (১) বুখারি, ১/২৬৯

তারাবিহ বিশ রাকাত (মূল কিতাব, পৃ. ১০৬)
১. আবদুল আজিজ বিন রাফি বলেন, উবাই বিন কাব রা. রমজান মাসে মদিনা শরিফে মানুষদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করতেন বিশ রাকাত আর বিতির পড়তেন তিন রাকাত।
১. মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা (হা. ৭৬৮৪)
২. হাদিসের সনদ শক্তিশালী মুরসাল। Ñআসারুস সুনান
৩. (পাদটীকা থেকে) এই অধ্যায়ে বর্ণিত ৫ খানা আসার-এর জন্য দ্রষ্টব্য: আসারুস সুনান, ২/৫৫, ৫৬ (হাদিস নং ৭৭৯, ৭৮০, ৭৮১, ৭৮৩, ৭৮৪)

২. ইবনু আবি শায়বা ইয়াহইয়া বিন সায়িদ থেকে শক্তিশালী মুরসাল সনদে বর্ণনা করেন, হজরত ওমর বিন খাত্তাব রা. এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবিহ পড়তে।
১. মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা (হা. ৭৬৮২)
২. হাদিসখানা শক্তিশালী মুরসাল সনদে বর্ণিত। Ñআসারুস সুনান

৩. হজরত সায়িব বিন ইয়াজিদ বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাবের যুগে রমজান মাসে লোকেরা কিয়ামুল্লাইল করত বিশ রাকাত।
১. সুনানে বায়হাকি, ২/৪৯৬ (হা. ৪২৮৮)
২. হাদিসের সনদ সহিহ। Ñসূত্র: ইমাম নববির শারহুল মুহাজ্জাব, ৪/৩২

৪. তাবেয়ি হজরত আতা বলেন, আমি মানুষদেরকে বিতিরসহ তেইশ রাকাত সালাত আদায় করতে দেখেছি।
১. মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা (হা. ৭৬৮৮)
২. হাদিসের সনদ হাসান। Ñসূত্র: আসারুস সুনান

৫. হজরত নাফে বলেন, রমজান মাসে ইবনু আবি মুলায়কা আমাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত সালাত আদায় করতেন।
১. মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা (হা. ৭৬৮৩)
২. হাদিসের সনদ সহিহ। Ñসূত্র: আসারুস সুনান

৬. সায়িদ বিন উবায়দ থেকে বর্ণিত যে, রমজান মাসে হজরত আলি বিন রবিআ তাদেরকে নিয়ে ৫ তারবিহা৬ (বিশ রাকাত সালাত) আদায় করতেন আর বিতির আদায় করতেন তিন রাকাত।
১. মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা (হা. ৭৬৯০)
২. হাদিসের সনদ সহিহ। Ñসূত্র: আসারুস সুনান

পাদটীকা :
১ হাদিসে নববির এ অমর গ্রন্থখানার পূর্ণাঙ্গ নাম হচ্ছে ‘ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসার’। সময়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা কিতাবখানার নির্বাচিত অংশের বঙ্গানুবাদ মূল আরবিসহ নতুন, আকর্ষণীয় ও উপকারী বিন্যাসে পাঠকের সামনে উপস্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করেছি। আল্লাহ তাআলাই যাবতীয় সদিচ্ছাকে আলোর মুখ দেখানোর মালিক। Ñঅনুবাদক
২ সাবেক ও ১ম খতিব, বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ, বাংলাদেশ। দেশবিভাগের আগে কলকাতা আলিয়া এবং বিভাগোত্তরকালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় দরস-তাদরিসের দায়িত্ব ও খেদমত আনজাম দিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর বিস্ময় এ মনীষী ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক সব শাখায়ই আল-হামদুলিল্লাহ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অমরত্ব লাভ করতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। আমাদের দেখামতে, বর্তমান গ্রন্থের অন্তত পাঁচটি সংস্করণ (পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মুদ্রণ) বাজারে চলছে। সম্প্রতি, লেবাননের বৈরুত থেকেও তাঁর এ অমূল্য গ্রন্থখানা অল্প কিছু সংযোজনসহ প্রকাশিত হয়েছে; তাতে মিসরের কায়রোয় অবস্থিত পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আল-আজহার-এর কয়েকজন শায়খ-এর মন্তব্য ও বাণী সংযোজিত হয়েছে। তাঁর ইনতেকাল ১৯৭৪ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৯৫ হিজরিতে। এ অনুবাদ প্রকাশের প্রাক্কালে তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং আল্লাহর জান্নাতে তাঁর উচ্চতম স্তর কামনা করে দুআ করছি। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ঐতিহ্যবাহী দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার সেই উদ্যোক্তাদের প্রতি যারা গ্রন্থখানার ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত নুসখাকে বাংলাদেশে প্রচারের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। Ñঅনুবাদক
৩ কুরআন খতম করতে সক্ষম এমন একজন হাফেজে কুরআন ইমামের কথা বলা হচ্ছে। অনুবাদক
৪ বিদআতে হাসানা বা উত্তম বিদআতের পক্ষে যেসব দলিল পেশ করা হয় সেসবের মধ্যে ওমর রা.-এর এই উক্তি একটি। অনুবাদক
৫ অর্থাৎ রাতের শেষাংশের তারাবিহ প্রথমাংশে আদায়কৃত তারাবিহের চেয়ে উত্তম। অনুবাদক
৬ প্রতি ৪ রাকাতে ১ তারবিহা; সে হিসেবে ৫ তারবিহার পরিমাণ হয় ২০ রাকাত। তারাবিহ শব্দ এই তারবিহা শব্দেরই বহুবচন। অনুবাদক

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *