আমাদের কিরাত,ইবনে মাসউদের (রা.) কিরাত

মাক্কী জীবনের প্রথমদিকে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর উপর শারীরিক নির্যাতন না থাকলেও আল্লাহর নবীর (স.) রিসালাতের দায়িত্বে বিগ্ন ঘটানোর কোন কসরত মক্কাবাসী ছেড়ে দেয়নি। কথাবার্তা এবং চালচলনের মধ্য দিয়ে শত্রুতা প্রদর্শনের মহড়া চলছিল। কিন্তু কোনভাবেই ইসলামের বার্তাকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। বিশেষত কুরআনুল কারীমের বিপক্ষে এসে আরব্য কবি-সাহিত্যিকরা হাটু মুড়ে বসে রইতেন। ইমাম বায়যাবী তাঁর তাফসিরে উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকদের সংখ্যার আধিক্য, কাব্যে পারদর্শিতা এবং ইসলামের সাথে শত্রুতা পোষণ করার সর্বোচ্চ অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর কালামের সামনে এসে তারা দূর্বল হয়ে যেত।
কুরআনের ভাবভঙ্গি, ভাষার মাধুর্য, নিখুঁত শব্দ ও বাক্য প্রকরণ, সাবলিল গাঁথুনি, অনুপম ছন্দরীতি, নিগূঢ় তত্ত্ব, ঐতিহাসিক জ্ঞানের ফুলঝুরি, বর্ণনার শৈল্পিকতা, স্বর ও সুরের দ্যোতনা তৎকালীন আরবি কাব্য-সাহিত্যের বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরকেও নবিশ বানিয়ে রেখে দিত। কবি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরাহ হোক কিংবা সমালোচক নযর ইবনে হারিস, জননেতা আবু জাহেল ইবনে হাকাম হোক কিংবা রাজনীতিবিদ আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, ব্যবসায়ী উমাইয়া ইবনে খালফ হোক কিংবা বিকৃতরুচির গুণ্ডা উকবা ইবনে আবু মুয়ীত… আল্লাহর কালামের বিপক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি ছিলনা কারো মধ্যেই। অতএব বাধ্য হয়ে তারা নতুন একটি পন্থা অবলম্বন করল। মুহাম্মদকে (স.) প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ করতে দেয়া হবেনা এবং মানুষকে শুনতে দেয়া যাবেনা। তবে যদি কিছু হয়!

সায়্যিদিনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কুরাইশরা যখনি রাসুলকে (স.) বাইতুল্লাহ শরীফের পাশে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখত তখনি অর্থহীন হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিত, যাতে তাঁর আওয়াজ মানুষের কানে না আসে। তারা অভিশাপ দিত যিনি কুরআন অবতীর্ণ করছেন (আল্লাহ) এবং যার উপর কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছে (মুহাম্মদ স.) উভয়ের উপর। সুতরাং যে কুরআন শ্রবণ করতে চাইত, সে এমন ভাব ধরত যেন সে শুনতে পাচ্ছেনা এবং নিজের কানকে রাসুলের (স.) দিকে ঝুঁকিয়ে দিত। এমতাবস্থায় রাসুল (স.) সর্বশক্তি দিয়ে জোরে জোরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন যে তা শ্রবণকারীর কর্ণকুহরে পৌঁছে যায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া আল্লাহর নবীর (স.) জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে যেত। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা’আলা আদেশ করলেন- আপনি নামাজের মধ্যে খুব উচ্চ আওয়াজে তেলাওয়াত করবেন না, আবার খুব নিচু স্বরেও তেলাওয়াত করবেন না। বরং আপনি এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করুন (সুরা ইসরা)।
এরপর সাহাবায়ে কেরাম দারুল আরকামে উপস্থিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার অন্য কাউকে দিয়ে তেলাওয়াত করাতে হবে। একেতো রাসুলের (স.) উপর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মুশরিকদেরকেও জানানো উচিৎ যে, আমরা ভীত নই। সুতরাং অন্যকেউ বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গণে তেলাওয়াতের দায়িত্ব নিক।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বীর-কণ্ঠে প্রস্তাব দিলেন- আমি তেলাওয়াত করব।
সাহাবিরা সাথে সাথে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আরে ভাই! তুমি কুরাইশী নও, এমনকি মক্কাবাসীও নও। তোমার কোন অভিজাত বংশধারা নেই। তারা তোমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। আমরা তোমাকে যেতে দেবনা।
ইবনে মাসউদ নাছোড়বান্দা। তিনি করবেনই! অগত্যা তাঁকে আল্লাহর যিম্মায় সপে দেয়া হলো।
পরদিন ইবনে মাসউদ বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে সুললিত কণ্ঠে সুরা আর-রাহমান তেলাওয়াত করতে শুরু করলেন। রাসুলকে (স.) না দেখে প্রথমে কুরাইশরা বুঝতে পারলনা কী হচ্ছে এখানে। অগত্যা তারা আল্লাহর কালামের সাহিত্যিক মাধুর্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্থবির রইল। এক রুকু শেষ হতে না হতেই কেউ একজন চিৎকার করে উঠল- আরে এতো মুহাম্মদের প্রভূর বাণী!
এরপরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়। পশুত্বের অবতারণা হলো বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গণে। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আধমরা অবস্থায় কোনমতে হায়েনাদের কবল থেকে ফিরে এলেন কুরআনের পাখি সায়্যিদিনা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, একমাত্র সাহাবি যিনি সরাসরি রাসুলের (স.) জবান মোবারক থেকে অন্তত ৭০টি সুরা আত্মস্থ করেছিলেন। যার সম্বন্ধে আল্লাহর নবী বলেছিলেন- তোমাদের মধ্যে কেউ যদি চায় যে, সে কুরআন এমন তরতাজা ও বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করবে যেভাবে তা অবতীর্ণ হয়েছে, সে যেন ইবনে উম্মে আব্দ (ইবনে মাসউদের উপনাম)-এর তেলাওয়াত অনুসরণ করে (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) এ বীরত্ব বৃথা যায়নি। প্রাথমিক যুগে পাঠের সুবিধার্থে কুরআন সাত/দশ কিরাতে পাঠ করা হতো। বিভিন্ন সাহাবি বিভিন্ন কিরাত চর্চা করতেন। ইবনে মাসউদের (রা.) নিকট থেকে তাঁর পঠিত কিরাতে কুরআন শিখেছিলেন প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আসেম আল-কুফী (রহ.)। তাঁর অধস্তনদের মধ্যকার কিরাতের পণ্ডিত ইমাম হাফস (রহ.) এই কিরাতকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করেছিলেন। আজ পৃথিবীতে দু’একটি মুসলিম দেশ (আলজেরিয়া, মরক্কো প্রমুখ) ব্যতীত সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এই কিরাত পাঠ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, কুরআনের অন্যান্য কিরাতসমূহ কোনভাবেই অগ্রহনযোগ্য নয় বরং প্রসিদ্ধ কারীগণ বিভিন্ন ধরণের কিরাতে পাণ্ডিত্য অর্জন করে থাকেন।
তবে আকীদা, ফিকহ, রাজনীতিসহ নানাবিদ বিষয় নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি থাকলেও আজ মাশরিক থেকে মাগরিব, শিমাল থেকে জুনুব পর্যন্ত, এমনকি পবিত্র মক্কা-মদীনায়ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) কিরাতে কুরআনুল কারীম পঠিত হচ্ছে।
আমাদের রাহবার আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) মক্কা শরীফে তাঁর উস্তাদ হযরত আহমদ হেজাজী মাক্কী (রহ.) এর নিকট থেকে ঐ কিরাত শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট সায়্যিদিনা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কিরাত অনুসারে কুরআনের পঠন-পাঠন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

Comments

comments

About

Check Also

সলফে সালেহিনের সুযোগ্য উত্তরসূরী আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

(প্রখ্যাত বুযুর্গ খলিফায়ে ফুলতলী আল্লামা মো. শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব (র.)-এর নিকট থেকে ২০০৯ সালের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *