আল মাহমুদ! আল মাহমুদ!
কোথায়, কেমন আছ?
জান্নাতেরই মগডালে কি
পাখির মতন নাচ?
বলো কবি, ফুল পাখিদের
দেয়ার আছে কিছু?
মহান মালিক; দরবারে তার
তাই কি মাথা নিচু?
২০০৪ সনে আল মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম ঘনিষ্ঠ সাক্ষাৎ। তখন ঢাকা ছিল দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ। আমার প্রথম কাব্য ‘সাদা তসবী’-র পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রচন্ড ভাবাবেগে তার বাসায় যাই। রাস্তায় জলের বেগের চেয়ে হয়ত আমার হৃদয়ের আবেগ বেশি ছিল, তাই সেই অচলাবস্থা আমাকে থামাতে পারেনি। ‘সাদা তসবী’র শুভেচ্ছা বাণীতে আল মাহমুদ আমার সেই আবেগ স্বীকার করেছেন। এছাড়াও তিনি কম সময়ের মধ্যে গড়গড়িয়ে অনেক কিছুই বলে ফেললেন। তিনি বললেন, ‘লেগে থাকলে এক সময় ছালেহী তার নিজের ভাষা আবিষ্কার করবে।’ নিজের ভাষা কী? সেটি হলো কবির স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্ব আঙ্গিক। বিষয় নির্বাচন, শব্দ চয়ন, ছন্দ নির্মাণ, উপমা ব্যবহার এবং অভিব্যক্তিতে একজন কবি থেকে অন্য কবিকে আলাদা করার যে সৌন্দর্য্য মাত্রা, তা-ই নিজের ভাষা। নিজের ভাষার কারণেই লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম, জীবনানন্দ, ফররূখ, সুকান্ত, আলী আহসান, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ নিজের কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছেন; এক অন্যের অন্ধ অনুকরণ করে চিনি-পানির মতো সন্ধি হয়ে যাননি।
‘নিজের ভাষার’ আরেকটি দিক হলো, নিজেই নিজেকে অতিক্রম করা। অবশ্য নজরুলের মতো যারা শক্তিশালী কবি, তাদের রচনা কৈশরেই পরিপক্ক হয় এবং আগা-গোড়া প্রায় একই রকম হয়ে থাকে।
আল মাহমুদের দু’একটি স্তবক চেখে নিলেই নিজের ভাষাটা উদ্ভাসিত হবে :
‘শুকনো নদির তলপেটে ঐ
ড্রেজার যখন হাতড়ায়,
ধানের ক্ষেতে পাওয়ার টিলার
ক্লান্ত হয়ে কাতরায়।’
বোতলের ভিতর জিন আটকানোর যে গল্প আছে, আমার মনে হয়-এ পংক্তিতে মাওলানার ভাসানীর ফারাক্কা-লং মার্চটাকে সে রকম আটকে রেখেছেন আল মাহমুদ। সচেতন-সন্ধানী পাঠক বোতলের ছিপিতে হাত ঘোরালেই দৈত্যরা বেরিয়ে এসে তাকে উস্কে দেবে: সেচ দিতে পাওয়ার টিলার কেন ক্লান্ত হলো? কেন নদির তলপেটে মরুচর জেগেছে? এই হলো ‘নিজের ভাষা’।
আল মাহমুদ কোনো রাজপুত-জমিদার নন। নজরুলের মতো খেটে খেয়ে বাঁচার জন্য যতসব নির্মম বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হয়েছে, সেসব অবস্থা থেকেই তিনি উপাদান পেয়েছেন; তাতেই তার রচনা শানিত হয়েছে। প্রকৃত কবিরা এমনই হয়ে থাকেন। তার ভেতরে বিশ্বাস ও আবেগ, বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা সমান্তরালে ভর করেছে।
একজন বড় কবি সীমাবদ্ধ হতে পারেন না। অথবা সীমিত আয়োজনে বড় হওয়া যায় না। আল মাহমুদ মনে করতেন, তিনি একজন বৈশ্বিক নাগরিক। তার কথায়, ‘কবিদের মাতৃভাষা একটাই-তা হলো কবিতা।’ তিনি বিশ্ব সাহিত্যের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করতেন।
আল মাহমুদ তার জীবনে বাঁক পরিবর্তন করে বঞ্চনারও শিকার হয়েছেন। আসল ব্যাপার হলো কোনো সুস্থ-স্বাধীন মানুষ নিজেকে ফাঁকি দিতে পারেন না। জেলের সেলে বড় দুুুুুটি ফুল ফুটতে দেখে তার অন্তর্জগতে ভাবান্তর হয়। সৃষ্টিতে স্রষ্টার শিল্পরূপ অবলোকন করে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন। এরপর জেলেই তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ব্যাপক বিশ্লেষণ করে প্রকৃত ধর্ম হিসেবে নিজেকে ‘প্রাক্টিসিং ইসলামে’ শামিল করেন। অবশ্য আগে থেকেই তিনি কিছুটা কাদ্রিয়া তরিকার ভাবানুরাগী ছিলেন। রমনা পার্কে এক ইফতার পার্টিতে আল মাহমুদকে সামনে নিয়ে আমি মুনাজাত পরিচালনা করেছিলাম। তখন তার চেহারায় যে আভা দেখেছি, তা একজন সত্যিকার বিশ্বাসী রোযাদারেরই হতে পারে। তিনি আল্লাহর কাছে শুক্রবারের ঈদের মৃত্যু চেয়ে পেয়েছেন। সবাই কি চাইলেই তা পায়?
একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সংগ্রামী কবির শেষ সান্নিধ্য থেকে পবিত্র শহীদ মিনারকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এ ধরনের সংকীর্ণতা শহীদ মিনার ক্ষমা করবে বলে মনে হয় না। কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী মনে করেন, এজরা পাউন্ডের মতো কবি হিটলার-মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ সমর্থন করার পরেও ইউরোপ সরকার তাকে প্রাপ্য জাতীয় মূল্য দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত আল মাহমুদের ধর্মীয়-রাজনীতি না দেখে কাব্য শক্তির মূল্য দেয়া।
আল মাহমুদের জাত-ধর্ম না দেখে তার প্রতিভার মূল্য দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, তার ‘কবিতা’ পত্রিকায়। ওপারেই মূলতঃ তার খানিকটা ভালো মূল্যায়ন হয়েছে। ‘জিজ্ঞাসা’র সম্পাদক প্রফেসর শিব নারায়ণও এক এক সংখ্যা আল মাহমুদের গুচ্ছ কবিতা ছাপাতেন। আল মাহমুদের পুরস্কার ও মূল্যায়ন বাংলাদেশের সরকার ও বুদ্ধিজীবীরা তখন করেছেন, যখন তিনি বাম ঘরানায় ছিলেন; সোনালী কাবিন বানিয়েছিলেন। কিন্তু ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ করতে গিয়ে তিনি তাদের দৃষ্টিতে ‘গোমরাহ’ হয়ে গিয়েছেন। ঠিকই আছে, মক্কায় খাত্তাবের ছেলে উমর দারুন-নদওয়ার বড় বীর সদস্য ছিলেন। যখন তিনি লাত-মানাতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাবার সামনে আল্লাহকে সিজদা করলেন, তখন আবু জেহেলরা তাকে আর সহ্য করতে পারছিল না। এরূপ বাস্তবতা ফররূখেরও হয়েছে। আল মাহমুদ তা প্রত্যক্ষ করেই ‘শেষ ভালোর’ দলে ঠাঁই নিয়েছেন। আল্লাহ, রাসুল ও বিশ্বের মুমিনদের কাছে তিনি তার আসল রাজমুকুটি পেয়ে গেছেন। আল মাহমুদকে স্মরণ করে আমি এরূপ দোয়াই করছি :
যে নাইওর কখনও ফেরে না,
আজ তুমি গেছ সেই স্বামীর বাড়িতে।
ওগো মহান স্বামী।
দয়া করে দিও তারে
‘বেহেশতের মিনারে’
লাল-গালিচার
গার্ড অব অনার।
ওহে কারীম! ওহে রব
না চাইতেই দিও তারে সব;
তব দরবারে
দিও তারে
ফুলেল বিছনায় আয়েশি ঘুম
আরো দিও তার কপাল জুড়ে-
বেহেশতের আকাশ থেকে
চাদিমার চুম।
খ্যাতির ঝরনামূল ‘সোনালী কাবিন’
থাক না অবিবর্ণ!
যেহেতু সব সন্তানই আহার দেয় না তুলে
অসহায় বাবার মুখে,
তাই-
দু’চারটি বিশ্বাসী পংক্তির সৌধ্ই
মুক্তির সোপান হবে আল্লাহর আদালতে।
তুমি ভাষা সৈনিক; মুক্তিযোদ্ধা তুমি
চার চেয়ে বেশি-তুমি বিশ্বাসী।
এই যা ভরসা…
Check Also
রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা
পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …