ইলমে কিরাতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর অবদান

হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর কর্মজীবন দীনের বহুমুখী খিদমতে নিবেদিত ছিল। তিনি সারাজীবন আল-কোরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দিয়েছেন, হাদীসে নববীর দারস দিয়েছেন, তরীকতের তা’লীমের মাধ্যমে মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ করেছেন, আর্ত মানবতার সেবা করেছেন। তাঁর বহুমুখী খিদমতের মধ্যে অন্যতম ইলমে কিরাত সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো।
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে তাফসীর, হাদীস ও ইলমে ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে যখন ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ (বর্তমানে জেলা) এর বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তখন তাঁর মুর্শিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.) তাঁকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেন। বদরপুরী (রহ.) এর তাকীদের ব্যাপারে হযরত আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এর নিজের ভাষ্য নিম্নরূপ:
“সে সময় উলামায়ে কিরামের ধারণা ছিল যে, ‘আমার কিরাত বিশুদ্ধ।’ কিন্তু বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ আমাকে সময় সময় বলতেন, ‘তোমার কিরাত কিছুটা অশুদ্ধ।’ একদিন বললেন, ‘তোমার কিরাত বিশুদ্ধ করে নিলে ভবিষ্যতে ভালো হতো।’ আমি জিজ্ঞাস করলাম ‘কার নিকট থেকে কোরআন শরীফ গিয়ে শুদ্ধ করব?’ উত্তরে বললেন, ভোগা নিবাসী মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী ছাহেবের নিকট গিয়ে কোরআন শরীফ শুদ্ধ করে নাও।”
মুরশিদের নির্দেশ পেয়ে তিনি প্রথমে বিশ্ববিখ্যাত কারী হযরত ইরকসূস আল মিসরী (রহ.) এর অন্যতম শাগরিদ হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (রহ.) ও পরবর্তীয়ে মক্কা শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক, মিসরী বংশোদ্ভূত, রঈসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (রহ.)-এর নিকট কিরাতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
আল-কোরআনুল কারীম তারতীলের সাথে (শুদ্ধ পাঠনপ্রণালী অনুযায়ী) তিলাওয়াতের শিক্ষা বিস্তার হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর অন্যতম খিদমত। স্বপ্নে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইঙ্গিতেই এ খিদমত শুরু হয়। ঘটনাটি নিম্নরূপ:
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) মক্কা শরীফ হতে পুনরায় যথারীতি বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাদান শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেওয়ার সময় সেখানে হযরত আব্দুন নূর গড়কাপনী (রহ.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুজুর্গ ছিলেন তিনি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন। ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ তাঁর কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের বেশ কিছু সংখ্যক আলিমের কিরাত শুদ্ধ নয়। তাই ছাহেব কিবলাহ দারসের কিরাতের জন্য অন্তত সাপ্তাহে ঘন্টাখানেক সময় যেন দেন আমাদের। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠাদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। একথার পর আব্দুন নূর ছাহেব চলে গেলেন।

পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আব্দুন নূর (রহ.) বললেন, আমি নিজে থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (রহ.) এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আব্দুন নূর (রহ.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর অনুরোধে তিনি বর্ণনা করলেন, ‘স্বপ্নে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখা গেল। আরয করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, কোরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনতে চাই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিলাওয়াত করে শুনালেন। আরয করলাম, এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান দিকে ইশারা করলেন। সেদিকে চেয়ে দেখা গেল, সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আপনি।’ একথা শুনার সাথে সাথে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কেঁদে ফেললেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ঠিক আছে আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (রহ.) (৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম) এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের দারস দেওয়ার ওয়াদা দিলাম।’ এভাবেই ছাহেব কিবলাহর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবৈতনিক ভাবে কিরাতের দারস দিয়েছেন।
১৯৫০ সালের ইংরেজি সনে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেন তিনি। কেননা রামাদান মাস হলো নুযূলে কোরআনের মাস।
প্রতি বছর রামাদানে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতে থাকেন। দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সবাইকে তা’লীম দিয়ে এবং সমগ্র কোরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে তবেই সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখাকেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহর ওয়ালিদ মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতি আব্দুল মজীদ চৌধুরী (রহ.) এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। ছাহেব কিবলাহ তাঁর ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এই ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। বর্তমানে এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় দেড় সহস্রাধিক শাখা কেন্দ্র দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে।

তথ্যসূত্র:
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *