লিবানের ভাগ

লিবানের বয়স সবে মাত্র সাড়ে ছয় বছর। ওর জন্ম লন্ডন শহরেই। জন্মের পর থেকে সেখানেই থাকা, প্রতি দুই বছর পর পর ওরা আসে বাংলাদেশে। ওর জন্ম ওখানে হলেও ওর বাবা মা দুজনেই বাংলাদেশী। এখানেই ওদের বড় হওয়া শৈশব কৈশোর এর দিন গুলো। বাবা মা দুজনেই ডাক্তার। লিবান ওদের বড় সন্তান।
লিবানের ভাই তারাজ, ওর বয়স দেড় বছর। দুই ভাইয়ের খুব ভাব। এই সাড়ে ছয় বছরে লিবানের সব ঈদ ওখানেই করা। বিদেশের মাটিতে ঈদের কি আর মজা আছে। বাঙ্গালী মুসলিমরা মিলে নামাজে যাওয়া হয়। একে অন্যের বাসায় যাওয়া হয় না। কারণ সেদিনও ওদের অফিস খোলা থাকে। নিজেরা নিজেরা সময় ঠিক করে একে অন্যের বাসায় যায়। লিবানদের পাশের বাসায় অন্য এক বাঙালি পরিবার ছিলো। কিন্তু তাদের কোন বাচ্চা না থাকায় লিবানের ছোট বেলাটা কাটে অনেকটাই একাকী। বাবা মা প্রায়ই ওকে নিয়ে বাহিরে বেড়াতে যেতো। বাহিরের সব দেখাতো। গতবছর লিবান দেশে আসে ঈদের কয়েকদিন আগে,ঈদটা এবার দেশেই করা হবে। ওর বাবা মোহাম্মদ ওকে বলে,
-এবার নিশ্চয়ই লিবান দেশে গিয়ে খুব মজা করবে।
-কেমন মজা হবে বাবা।
-বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ শুরু হয় সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই।
-তাই নাকি বাবা, তো এত দিন ধরে সবাই কি করে?
-এই যেমন গরু কেনা। গরুকে কোথায় রাখবে, কি খাওয়াবে, কে গোসল করাবে। কে ঘাস আনবে, কে ভুসি আনবে কোথায় বেঁধে রাখবে? এই সব এই সব আর কি।
-বাবা গরু কোথায় কিনতে পাওয়া যায়?
-ঈদের একমাস আগে থেকেই সবার প্রস্তুতি চলে। ১০ দিন আগে বিভিন্ন জায়গায় গরুর হাট বসে। তবে এখানে সেখানে হাট বসতে পারে না। কিছু জায়গা নির্ধারিত করে দেয়া হয় সেখানেই বসে গরুর হাট। যাদের গরু রাখার জায়গা আছে তারা আগেই কিনে নিয়ে আসে। আর যাদের জায়গা থাকে না তারা পরে কিনে। মানে ঈদের আগের দিন কিনে।
-বাবা গরুকে কোথায় রাখতে হয়?
-এই যেমন গ্যারেজ এ রাখা যায়। বাগানে রাখা যায়। শহর এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ গ্যারেজেই রাখে।
-বাবা গরু কি খায়?
-গরুর খাবার সাধারণত ভুসি, খড়, ঘাস, ভাতের মাড় আর খৈল।
-খড় কি বাবা।
-খড় হলো শুকনো ধানগাছ। ধান গাছ থেকে যখন ধান আলাদা করা হয়, তখন গাছগুলোকে শুকাতে দিতে হয়। আর শুকনো গাছগুলোকে জমা করে রাখে গরুর জন্যে।
-গরুকি সব সময় খড় খায়।
-না,তা খায় না। ওর জন্যে ঘাস নিয়ে আসতে হয়। একবার এই খাবার আবার ওই খাবার এমন করে দিতে হয়। এই যেমন আমরা সকালে নাস্তা হিসাবে যা খেয়ে থাকি দুপুরে কি তা খাই। আবার রাতে কি তা খাই। তেমনি গরুকেও আলাদা খাবার দিতে হয়।
-এত গরু কোথা থেকে আসে।
-আসে বলতে অনেকেই এই ঈদের জন্যে আগে থেকেই গরু লালন পালন করে, সেই গরু বিক্রি করে। তবে শুধু গরু না, কেউ কেউ খাসি, ভেড়া, উট এগুলোও কোরবানি দেয়।
-বাবা এবার কি তাহলে আমিও গরুর হাটে যাব?
-তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি লিবান। বাবাতো ছুটি পেয়েছি কম, তাই আমি ঈদের আগেই ফিরে আসবো। তুমি ভাইয়া, মা মনি, তোমরা দাদা, দাদী, চাচু,চাচী, নানু, মামা, খালামনি, ফুপ্পি ও আপু ভাইয়াদের সাথে ঈদ করবে।
-তাহলে আমি কার সাথে গরুর হাটে যাবো?
-নিশ্চয়ই তোমার চাচু আর দাদা তোমায় সাথে করে নিয়ে যাবে।
লিবান ঈদ নিয়ে খুব এক্সাইটেড। ওরা দেশে আসে, মোহাম্মাদ ১৫ দিন থেকে চলে যায়। লিবানরা দাদার বাসা আর নানার বাসা মিলিয়ে বেড়াচ্ছে।
ঈদের ৪ দিন আগে দাদা বাড়িতে আসে। ঈদ আসতে আরো তিনদিন বাকি। একবিকেলে চাচ্চুর সাথে গরুর হাটে যায়। সারি সারি গরু বাঁধা। গরুর হাটের পাশেই গরুর খাবার সহ অনেক দোকান সাজানো। লিবানের মনে পড়ে বাবার কথা, বাবাতো অনেক কিছুই বলেছে। তবে নামগুলো মনে নেই। এমন হাট বাজার এই প্রথম দেখছে ও। চাচ্চুকে বলে,
-এইগুলো কিসের দোকান চাচ্চু।
-এ গুলো গরুর খাবার।
-চাচ্চু এটাকে কি খড় বলে?
-হ্যাঁ, তুমি কিভাবে জানলে লিবান।
-কেনো? বাবা আমাকে বলেছি। এগুলো শুকনো ধানগাছ।


এরপর লিবান চাচ্চুর সাথে সব গল্প করে,বাবা ওকে অনেক কিছু বলেছে। সে দিন ওরা গরু কিনে নি। আসলে দেখার জন্যেই যাওয়া। কাল আবার আসবে। এখানে পছন্দ হলে কিনবে, না হয় গরুর বড় হাটে যাবে। চাচুর সাথে লিবান বাসায় ফিরে। ঈদে কি করতে হয় সেই সব গল্প শুনে।
পরেরদিন লিবানকে বাসায় রেখে ওর চাচ্চু ইব্রাহীম কয়েক বন্ধুকে সাথে করে যায় গরু কিনতে। লিবানকে বলে যায় ভাতের মাড় নিয়ে অপেক্ষা করতে। লিবান চাচ্চুকে বলে…
-চাচ্চু বড় গরু কিনবে। গরুর গলায় মালা পরিয়ে নিয়ে আসবে।
ঘন্টাখানেকের মাথায় লিবানের চাচ্চু গরু নিয়ে আসে। দাদী বলে…
-লিবান তোমার চাচ্চু নিশ্চয়ই গরু নিয়ে এসেছে। চলো আমরা গরু দেখতে যায়।
-দাদী দাদী ভাতের মাড় নিয়ে যেতে হবে, আমি গরুকে ভাতের মাড় খাওয়াব।
সবাই মিলে নিচে যায়। গরু দেখে। গরুটা অনেকটাই লাল । মাঝে মাঝে একটু কালো আছে।
ভোর হলেই ঈদ, লিবানের বাবা কল করে। লিবান নিজেই গরু কেনার খবর দেয়। গরুকে নিয়ে তার যত্ত কথা সব বলতে থাকে। বাবাকে বলে,
-এর পরেরবার কিন্তু তুমি সহ ঈদ করবো।
-আল্লাহ্ চাইলে তাই হবে বাবা। তুমি সবার সাথে মজা করো।
চাচ্চু বলে দিয়েছে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। গরুকে গোসল করাতে হবে। লিবানের চোখে ঘুম নেই। কখন রাত পোহাবে, যথারীতি সকাল হলো। গরুকে সবাই মিলে গোসল দিলো। লিবান গরুর কাছে না আসলেও দূর থেকেই সব দেখছে। চাচ্চুর সাথে নামাজে যায় লিবান। বাসায় আসার পর দাদী ওকে গল্পের মাঝে রেখে দেয়। এই ফাঁকে গরুকে কোরবানি দেয়া হয়। গ্যারেজে গরু কাটা হচ্ছে, লিবান নিচে এসে গরুকে খুঁজতে থাকে। দাদা ওকে সব বুঝিয়ে বলে। গরুকে কোরবানি দেয়া হলো। আল্লাহ্ খুশি হয়েছেন। এখন এই মাংস ধনী গরিব সবার মাঝে ভাগ করা হবে, নিজেরা খাবে, আত্মীয় স্বজনদের দেয়া হবে।
ঘন্টা দুই পর সব মাংস বাসায় আনে। ভাগ করে একভাগ গরিবদের বিলিয়ে দেয়। নিজেদের জন্যে একভাগ রাখে আর একভাগ আত্মীয় স্বজনদের নাম বলে বলে ভাগ করে। চাচ্চু আর দাদী ভাগ করতে বসছে,
এই ভাগ নানুদের, এই ভাগ ফুফুদের, এই ভাগ মামাদের। এই ভাবে ভাগ করে করে রাখা হচ্ছে আলাদা করে। সোফায় বসে লিবান দেখছে। হঠাৎ বলে বসে,
-ও চাচ্চু, ও দাদী সবার নামে ভাগ আছে আমার ভাগটা কই?
সব্বাই সেই কি হাসি। তাইতো লিবানের ভাগটা কই?
দাদী বলে,
-এই যে লিবান এটা পুরোটাই তোমার ভাগ। তুমি আমাদের সবাইকে তোমার সাথে রাখবেতো।
-রাখবো মানে, রাখবোই তো।
বিকেলে মোহাম্মাদ কল করে। লিবান নিজেই কল ধরে বলে,
-যানো বাবা সবার চেয়ে আমার ভাগটা অনেক বড়। তবে কারো ভাগে কেউ নেই। আমার ভাগে আছে, আম্মু, ভাইয়া, দাদা, দাদী, চাচ্চু, চাচী, ফুফি, নানু, মামা সব্বাই। আমি সবাইকে নিয়েই আছি। পরের বার তুমিও কিন্তু থাকবে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *